বিদ্যার সাথে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ এবং জীবনের সাথে সম্পর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু ।

ভাবসম্প্রসারণ: জীবনের প্রয়োজনে বিদ্যা, আর একারণেই বিদ্যাকে হতে হয় জীবনমুখী। মানুষ বিদ্যার্জনের মাধ্যমে তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন করে। মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা মুক্তি পায় বিদ্যার স্পর্শে। মানুষের অনন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার কেন্দ্রে নিহিত রয়েছে বিদ্যার যাদুস্পর্শ। বিদ্যা মানবজীবনের অন্ধকার দূর করে মানুষকে আলোকিত, সমৃদ্ধ ও মহীয়ান করে তোলে। বিদ্যার বলেই মানুষ ক্ষুদ্রতার গণ্ডিমুক্ত হয়, পৃথিবীর অফুরন্ত সম্পনকে করায়ত্ত করে, সমগ্র সৃষ্টিকূলের ওপর আপন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বিদ্যার আলোকেই প্রকৃতির অন্তর্গত রহস্য ভেদ করে প্রকৃতিকে মানুষ আপন প্রয়োজনে ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে। লোহা-লক্কড় নিয়েই ইঞ্জিন তৈরি হয়, যে কোনো ইঞ্জিনমাত্রই লোহা-লক্কড়ের সমষ্টি; কিন্তু লোহা- লঞ্চড়মাত্রই ইঞ্জিন নয়। মানুষ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে লোহা-লক্কড়কে ইঞ্জিনে রূপান্তরে সক্ষম হয়েছে। আবার প্রকৃতির সৌন্দর্য সবার সামনে সমানভাবেই দৃশ্যমান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেভাবে প্রকৃতির রহস্য ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করেছেন, সাধারণ মানুষ সেভাবে উপলব্ধি করে না বা করতে পারে না। মানুষে মানুষে দেখার, শোনার, বলার এবং উপলব্ধির ক্ষমতার হেরফের হয় মানুষের জ্ঞানার্জনের তারতম্যের ওপর। জ্ঞান মানুষের সকল ইন্দ্রিয়ের চোখ খুলে দেয়, অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দেয়। মোদ্দাকথা হচ্ছে, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অনাবিষ্কৃতকে আবিষ্কার করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিদ্যার্জন। বিদ্যার আলো-বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে ইতর প্রাণীর তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না, পশুর সঙ্গে মানুষের যতটুকু ব্যবধান রচিত হয়েছে সবটুকুর মূলে রয়েছে মানুষের জ্ঞানার্জনের প্রয়াস। বিদ্যার্জনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবজীবনকে উন্নত করা। অর্থাৎ বিদ্যাকে হতে হবে জীবনমুখী। যে বিদ্যা জীবনকে উন্নত করে না, জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না, জীবনের প্রয়োজন পূরণে অপারগ, সে বিদ্যা অর্থহীন। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যা মানবসভ্যতার জন্য অনেক সময় বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রসঙ্গত বলা যায়, প্রতিটি ধর্মের মৌলিক চেতনা হলো মানুষের জাগতিক ও পারলৌকিক মুক্তি; মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্যই ধর্মের আবির্ভাব। কিন্তু ধর্মের খণ্ডিত ও জীবনবিমুখ শিক্ষা মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা ধর্মের নামে পরিচালিত সাম্প্রতিক সহিংসতা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জীবনধর্মী শিক্ষাই মানুষকে ধর্মে, কর্মে, জ্ঞানে মহিমান্বিত করে; আর জীবনবিমুখ শিক্ষা মানুষকে নিক্ষিপ্ত করে ধ্বংসস্তূপে।



বিদ্যা জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিদ্যাহীন জীবন অন্ধের সমান, আর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যা অর্থহীন ও পঙ্গু। 

সম্প্রসারিত ভাব
মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই যথার্থ মানুষ হওয়া যায় না। তাকে কঠোর সাধনা করে বিদ্যা অর্জন করতে হয়। বিদ্যা মানবজীবনের অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অন্ধকার দূর করে জীবনকে করে তােলে মহীয়ান ও সুষমামণ্ডিত। বিদ্যার উদ্দেশ্য মানুষের চিন্তাচেতনাকে পরিচালিত করা, দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করা। বিদ্যা জীবনমুখী হওয়া আবশ্যক, জীবন বিবর্জিত নয়। বিদ্যা যদি জীবনমুখী হয় তাহলে তা জীবনকে আলােকিত করতে পারে না, বরং জীবনকে তা অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। 
স্বাভাবিকভাবেই আমরা বলতে পারি, বিদ্যার সঙ্গে যে জীবনের কোনাে সম্পর্ক নেই সে জীবন আলােকবতি অথবা অন্ধ! অন্যদিকে যে বিদ্যা জীবনের সাথে সম্পর্কহীন, যা জীবনকে সামনে চালিত করতে পারে না, সে বিদ্যা চলার গতি হারিয়ে স্থবির হয়ে যায়। জীবনকে উজ্জীবিত করতে বিদ্যার সংশ্লিষ্টতা তাই অপরিহার্য। বিদ্যার সাহচর্যেই মানবজীবন হয় মােহমুক্ত, সতেজ ও আনন্দপূর্ণ। মানবজীবনকে সুন্দর, সতেজ ও সাবলীল করে গড়ে তুলতে হলে বিদ্যাকে অবশ্যই জীবনধর্মী হতে হবে। জীবনের সাথে সম্পর্কহীন বিদ্যা কখনাে ফলপ্রসূ হয় না। তাই শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে হবে। যে শিক্ষার সঙ্গে জীবনের কোনাে যােগ নেই, সে শিক্ষা অর্থহীন। জীবনকে গতিময়, বাস্তব ও কর্মমুখী করতে হলে যেমন বিদ্যার্জন অত্যাবশ্যক, তেমনই অর্জিত-বিদ্যাও হতে হবে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। 
মন্তব্য
বিদ্যার সাহায্যে জীবনকে সার্থক করে তােলা যায়। বিদ্যাহীন জীবন প্রকৃতপক্ষে অন্ধ। তাই বিদ্যা বা শিক্ষার সঙ্গে চাই জীবনের নিবিড় সম্পর্ক। আর এ শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা।