দুঃখের মত এত বড় পরশ পাথর আর নেই।

অথবা, সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা,

আশা তার একমাত্র ভেলা। ভাব-সম্প্রসারণ: সুখের কামনা মানুষের চিরায়ত, দুঃখের আঁচ জীবনে পড়ুক তা কেউ কখনো কামনা করে না। কিন্তু দুঃখ জীবনে আসে জীবনের নিয়মেই আসে পালা করে। দিন-রাতের আবর্তনের নিয়মেই যেন সুখ-দুঃখ জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। তাই সুখের দিনের আনন্দের পাশাপাশি জীবনের দুঃখ-রাতির ঘন তমসার জন্যও মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হয়। আবার সীমাহীন দুঃখের মধ্যেও মানুষ আশান্বিত হতে পারে এই ভেবে যে, দুঃখ কোনো চিরন্তন ব্যাপার নয়, রাতের অবসানে যেমন অরুণোদয় হবেই। জীবন কখনোই পুষ্পশয্যা নয়, সংসারে নিরবচ্ছিন্ন সুখ কারোর জন্যই নির্ধারিত নয়। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের প্রত্যাশা বিপুল। বলাবাহুল্য, প্রত্যাশা কখনো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যায় না; প্রত্যাশা পূরণের জন্য মানুষকে পরিশ্রম করতে হয়, কখনো লিপ্ত হতে হয় কঠোর সাধনায়। কখনো বহু কষ্টে পূরণ হয় প্রত্যাশা; আবার অনেকসময় কোনো চেষ্টায়ই ঘটে না প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মেলবন্ধন। জীবনে নেমে আসে গভীর হতাশা, দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে জীবন। কিন্তু চিরঞ্জয়ী মানুষেরা কখনোই পরাভূত হয় না, হতাশাকে নিত্য সত্য বলে ভাবে না, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে রচনা করে নতুন স্বপ্নের জাল। অসীম ধৈর্য ও সাহসে যে ব্যক্তি লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকে, দুঃখের দীর্ঘ আধার কেটে তার জীবনে সুখের সোনালি সকাল আসবেই। প্রত্যাশা যত বড় হবে, তা অর্জনের পথে বাধাবিঘ্ন, ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-যন্ত্রণার মাত্রাও হবে তত গভীর ও ব্যাপক। কোনো কিছু অর্জনের ক্ষেত্রে কষ্টের মূল্য যত বেশি হবে, তার প্রাপ্তির আনন্দও হবে তত বেশি প্রশান্তিনায়ক। জগৎ-সংসারে অভাব আমাদের নিত্য তাড়া করে, অভাব পূরণ হলে আমাদের মন আনন্দে দ্রবীভূত হয়, আবার অপূরণের অনেক কষ্ট মনের কোণে কিন্তু জমায়। দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষের পক্ষে সাজে না, বরং পরম ধৈর্যে ও নিষ্ঠায় দুঃখকে জয় করার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটাই মানুষের জন্য স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, দুঃখই মানুষের জীবনের সাফল্যের বীজমন্ত্র। মানুষের সকল বড় অর্জনের পটভূমিতে আছে সীমাহীন দুঃখ-কষ্টের ইতিহাস। মাতৃত্বের আনন্দ কষ্ট ছাড়া অসম্ভব; বিজয়ের মূল্যও দুঃখের মধ্যেই নিহিত। জীবনে কষ্ট যত তীব্র ও ঘনীভূত হয়, সুখের সম্ভাবনা তত নিকটবর্তী হয়। জীবনে কষ্ট এক পরশ পাথর, কষ্টের ভেতর থেকে উদ্ভব ঘটে মানুষের বড় কোন সাফল্যের। পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন এমন সকল কীর্তিমান মানুষের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁদের প্রত্যেককেই ভীষণ কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। চরম বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে তাঁদেরকে সংগ্রাম করতে হয়েছে - কখনো কখনো মৃত্যু এসে হানা দিয়েছে তাঁদের জীবনে। কিন্তু চরম বিপর্যয়েও মহামানবদের আশাহত হতে দেখা যায় না। সমৃদ্ধ ও কল্যাণময় আগামী নির্মাণের স্বপ্নে তাঁরা অবর্ণনীয় কষ্টকেও অম্লান বদনে সহ্য করেছেন। তাই কষ্টকে অস্বীকার করে নয়, কষ্টে মূহ্যমান হয়েও নয়, কষ্টের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েই বুকভরা আশা নিয়ে মানুষকে সাফল্যের সরণিতে উপনীত হওয়ার সাধনা করতে হবে।