স্বদেশপ্রেম রচনা - Shodesh Prem Bangla Rochona:

স্বদেশপ্রেম রচনা

 ভূমিকা

মাতৃভূমির প্রতি অনুরাগ মানুষের সহজাত প্রবণতা। স্বদেশের ধুলিকণা গায়ে মেখে, স্বদেশের শস্য-দানায় শরীরের পুষ্টিসাধন করে, স্বদেশের প্রকৃতির শ্যামল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েই মানুষের জীবন। মায়ের কোলে মতোই দেশ মানুষের কাছে এক পরম নির্ভরতার স্থল, এক বরাভয় আশ্রয়। দেশ তাই মানুষের চেতনার অংশ, দেশের সঙ্গে মানুষের সময় সাম্ভার সংযোগ। মানুষের চেতনায় নিরন্তর বয়ে যায় দেশপ্রেমের অনিঃশেষ ফল্গুধারা। দেশকে ভালবেসে মানুষ নিজেকে ধন্য করে, নিজেকে পূর্ণ করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে ধ্বনিত হয় দেশের প্রতি বাঙালির অনুরাগ.


স্বদেশপ্রেম কী

"সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,

সার্থক জনম মা গো তোমায় ভালবেসে "

নিজের দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি, দেশের প্রকৃতির প্রতি বিমুগ্ধ ভালবাসা আর গভীর শ্রদ্ধাবোধই হলো স্বদেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেম উৎসারিত হয় মানুষের আত্মার নিবিড় চৈতন্যবোধ থেকে। দেশের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর গৌরবের অনুভূতি তার অভিভূত মনকে আচ্ছা করে রাখে। দেশপ্রেমীর মনে স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি এত প্রগাঢ় হয় যে, স্বদেশের কোনো অবমাননা অথবা স্বদেশবাসীর দুঃখ-দৈন্য নিরসনে নিতান্ত হেলায় নিজের জীবন, ধন, মান সর্বস্ব উৎসর্গ করে নিতে পারে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত মানুষদের নিবেদিতপ্রাণ কর্মযজ্ঞেই গড়ে ওঠে একটি দেশের সমৃদ্ধির সৌধ, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠে দেশটির গৌরবময় অবস্থান।


দেশপ্রেমের উৎসবী

বিশ্বময় বিরাজমান প্রতিটি প্রাণিরই নিজের জন্মস্থান ও পরিবেশের প্রতি রয়েছে অন্তর্নিহিত টান। বনের পশুকে লোকালয়ে আনলে সে তার স্বাভাবিক জীবন হারায়, মর্মান্তিক যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে। নীড়ের প্রতি আসক্তি পাখির চিরায়ত। প্রাচুর্যময় ইমারতের চেয়ে খড়কুটোর দরিদ্র আবাসই তার কাছে শ্রেয়। পাখিকে নীচ্যুত করলে সে আর্তনাদ করে ওঠে। কোনো সুরক্ষিত আশ্রয়ের মোহে কখনোই বিবর ত্যাগ করে না মুখিক। তার মানে জন্মস্থানই সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, জন্মস্থানেই সবাই নিজেকে নিরাপদ ও স্বামর্শ অনুভব করে। অনুরূপভাবে, দেশ মানুষের কাছে এক সুবিশাল বাসগৃহস্বরূপ। নিজ আবাসের প্রতি নাড়ীর টানেই মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে দেশের প্রতি ভালবাসা।


দেশপ্রেমের স্বরূপ

স্বদেশের উপাদান নিয়েই তৈরি হয় মানবদেহের অণু-পরমাণু- অস্থি-মজ্জা, রক্ত-মাংস। দেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জৈব-মানসিক। এ কারণেই দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতায় সে অনুভব করে অঙ্গহানির যন্ত্রণা। স্বীয় দেশ দরিদ্র হলেও দেশপ্রেমী মানুষের কাছে দেশের মর্যাদা রাজরাণীর। দেশের প্রতি সুগভীর অনুরাগ ও আনুগত্যের কারণেই স্বদেশের সুখের দিনে মানুষ আনন্দে পরিপ্লাবিত হয়, দেশের যে কোনো গৌরবে নিজে হয় গৌরবান্বিত; আবার দেশের কোনো দুর্যোগে সে গভীর বেদনা অনুভব করে, স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মত্যাগেও দ্বিধা করে না। স্বদেশপ্রেম দেশের মানুষকে নিজের সবকিছু উজাড় করে দিতে উদ্বুদ্ধ করে।


দেশপ্রেমিকের গুণাবলি

একজন দেশপ্রেমিক সবসময় স্বদেশের মঙ্গল-চিন্তায় থাকে বিভোর, স্বদেশের মঙ্গল সাধনে নিবেদিত। তার কাছে স্বার্থপরতা ও আত্মসুখ নিতান্তই তুচ্ছ। একজন যথার্থ দেশপ্রেমিক দেশের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় দুঃখকে বরণ করে, হাসিমুখে পান করে মৃত্যুর হলাহল। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করতে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশপ্রেমী জনতা, শত্রু নিধনের যজ্ঞে হাসতে হাসতে প্রাণ নেয় অকুতোভয় দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য যারা জীবনপণ লড়াই করে তারা যেমন দেশপ্রেমিক; তারাও দেশপ্রেমিক, যারা স্বদেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি সাধনে নীরবে নিভৃতে কাজ করে যায়। কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, শ্রমজীবী মানুষ তাদের মেধা ও মননের চর্চায় এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে কোলে দেশের সমৃদ্ধির সোপান, বিশ্ব-সভায় নিশ্চিত করে দেশের জন্য গৌরবের আসন। এভাবেই দেশের প্রতি তাদের গভীর ভালবাসার অভিপ্রকাশ ঘটে।


স্বদেশপ্রেমের উদাহরণ

স্বদেশের স্বাধীনতা, গৌরব ও মর্যাদা রক্ষার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ দেশপ্রেমের প্রেরণায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ লোকের আত্মদান মানবেতিহাসে দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির। দেশপ্রেমের কঠিন ব্রতে উত্তীর্ণ হয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকবি হয়ে উঠেছেন স্বদেশ ও মাতৃভাষাকে ভালবেসেই। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জগদীশ চন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তীতুমীর, মাস্টার্সা সূর্যসেন- এমনি আরো বহু দেশপ্রেমিকের কীর্তিতে উজ্জ্বল হয়েছে বাংলা মায়ের শ্যামল মুখ। উপমহাদেশে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, এ.পি.জে. আব্দুল কালাম প্রমুখ মনীষীগণ। ইতালির গ্যারিবন্ডি, চীনের সান ইয়াকসেন, মাওসেতুং, আয়ারল্যান্ডের ফেলোরা, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন, মার্টিন লুথার কিং, রাশিয়ার লেনি, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, দক্ষিণ আমেরিকার নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ ব্যক্তির অতুলনীয় দেশপ্রেম পৃথিবীর ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে।


জাতীয় জীবনে দেশপ্রেমের গুরুত্ব

জন্মভূমি জননীর মতো। মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়ে মায়ের শরীর থেকে রস নিয়ে যেমন একজন শিশু বেড়ে ওঠে, মায়ের অস্তিত্ব ছাড়া যেমন সন্তানের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি দেশহীন মানুষের অস্তিত্বও কল্পনা করা অসম্ভব। জন্মভূমির আলো, বাতাস, খাদ্য, পানীয় সেবন করেই মানুষ বেঁচে থাকে, বড় হয়ে ওঠে। তাই দেশের সঙ্গে মানুষ আত্মিক বন্ধনে বাঁধা। সন্তানের ভালবাসায় মায়ের মুখের হাসি যেমন মুক্তো নামার মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তেমনি দেশপ্রেমী মানুষের অপার ভালবাসায়, ত্যাগে, কর্মে দেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়। দেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁচে না, দেশ বাঁচে মানুষের ভালবাসায়। জন্মভূমির প্রতি মানুষের ঋণ অনুভব করতে হয়, ঋণের দায় থেকেই মানুষ দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়, এ ক্ষণই দেশের উন্নয়নে ও সেবায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। দেশের মানুষ তাদের কর্মতৎপরতায় দেশকে যতটুকু সমৃদ্ধ করে, দেশ ততটুকুই এগোয়। মনে রাখতে হবে, দেশ সম্মানিত হলে এর মানুষও সমানভাবে সম্মানিত হয়। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত দেশপ্রেমের যে চেতনায় ১৯৭১-এ আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছি, সেই একই চেতনায় শাণিত হয়ে দেশকে দারিদ্রমুক্ত করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। এক্ষেত্রে সর্বান্নে প্রয়োজন, নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ পরিহার করা। দেশের প্রতি গভীর আবেগ নিয়ে আমরা যদি দেশের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করি, জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় নিবেদিত হই, দুর্নীতি পরিত্যাগ করে নিজ নিজ কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করি, সন্ত্রাস-হত্যা-রাহাজানি বন্ধ করে দেশের উৎপাদন বাড়াতে আত্মনিয়োগ করি, বিদেশি পণ্যের প্রতি মোহ ত্যাগ করে দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াই, দেশের প্রতি আনুগত্য বাড়িয়ে নাগরিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন পারি, তবেই দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসা পূর্ণতা পাবে। অন্যথায় দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসা ফাঁকা আওয়াজে পরিণত হবে মাত্র।


প্রবাসে দেশপ্রেমের উপলব্ধি

প্রবাসে মানুষ দেশের সঙ্গসুধা থেকে বঞ্চিত হয়। স্বঞ্জনবিহীন বিচ্ছিন্ন পরিবেশে স্বদেশের প্রতি মানুষের আবেগ যথার্থ পরিসর লাভ করে। প্রবাসে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে জন্মভূমির যথার্থ মূল্য। যেমনটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন প্রথম জীবনে জন্মভূমি-বৈরী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে অনুতপ্ত কবি এক অপার আবেগে জন্মভূমির বন্দনায় মেতে উঠেন।

"বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-সলে

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?

বদ্ধ স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।”

প্রবাসে স্বদেশ হাতছানি দিয়ে ডাকে। দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে দেশের স্নেহময় সংস্পর্শে এলে মানুষের তৃষ্ণা-কাতর প্রাণের ওপর দিয়ে যেন গভীর শান্তিদায়ী অমৃতরসের ফোয়ারা বয়ে যায়।


স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের পারস্পরিক সম্পর্ক

সঙ্কীর্ণ স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে মানবতাবাদে নিহিত রয়েছে দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মূল। স্বদেশপ্রেমের ভ্রূণেই জন্ম নেয় বিশ্বপ্রেম। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালো বাসতে বাসতেই একজন স্বদেশপ্রেমী মানুষ বিশ্বকে ভালবাসতে শেখে। দেশের প্রতি উৎসারিত ভালবাসা একসময় বিশ্বপ্রবাহে ধাবিত হয়; তখন একজন দেশপ্রেমী তার দেশের মধ্যেই পেয়ে যায় বিশ্বের মহাবার্তা। বাংলার কবি দেশকে ভালবেসেই হয়ে যান বিশ্বকবি, বাংলার কায়ায় দেখেন বিশ্বে ছায়া ।


উগ্র দেশপ্রেম

“ও আমার দেশের মাটি, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা

তোমাকে বিশ্বময়ীর, তোমাকে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।”

দেশপ্রেম কখনো কখনো উনার প্রশস্ত রাস্তা ছেড়ে সঙ্কীর্ণতার পথে হাঁটে, তখনি জন্ম নেয় অতি-দেশপ্রেম, যার রূপ প্রমত্ত, পরিণতি ভয়ঙ্কর। উহা দেশপ্রেমের বিনাশী পরিচয় বিশ্ব পেয়েছে দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। জার্মানির হিটলার আর ইতালির মুসোলিনীর উগ্র দেশপ্রেমের বলি হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশপ্রেম সবসময়ই শুরু, কল্যাণকর, কিন্তু উগ্র দেশপ্রেম কট্টর জাতীয়তাবাদের জন্ম নেয়, যা চিরকালই অকল্যাণের ও অশান্তির।


মানুষের ওপর স্বদেশপ্রেমের প্রভাব

স্বদেশপ্রেমের শেকড় মানুষের মনুষ্যত্বে। দেশপ্রেম মানুষের মন থেকে মুছে দেয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি, মানুষের মনে বয়ে আনে মহন্ত। স্বদেশপ্রেমীর তপস্যা ত্যাগের, দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মন্ত্রে তার মন উজ্জীবিত। স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিকদের ত্যাগের প্রভায় গৌরবোজ্জ্বল হয়েছে মানবেতিহাস। অনাদিকালের মানুষ ঐ মহাপুরষদের কাছ থেকে পেয়েছে আত্মত্যাগের দীক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অবিনাশী প্রেরণা।


উপসংহার

দেশপ্রেম পবিত্র ও কল্যাণকর। দেশপ্রেমীদের ত্যাগে আর দায়িত্ববোধেই একটি দেশ উন্নতির শিখরে আরোহণে সক্ষম হয়। দেশপ্রেমিকের ভাবনা জুড়ে থাকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ। প্রতিটি মানুষেরই উচিত দেশকে ভালবাসা ও তার কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, দেশের প্রতি ভালবাসার আতিশয্যে অন্য কোনো দেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, মানবতা যেন কোনোভাবেই লঙ্ঘিত না হয়। এটি নিশ্চিত হলেই দেশপ্রেম সর্বাংশে কল্যাণদারী হবে।